
রুয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালে একশ দিনের গণহত্যার সময় ধর্ষণের কারণে ঠিক কত শিশু জন্মগ্রহণ করেছিল তার সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। ঠিক তখনই ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ২৪ বছর বয়সী রুয়ান্ডার এক নাগরিকের মা।
রুয়ান্ডার সেই নাগরিক জানাচ্ছেন, কিভাবে তিনি তার জন্মের পেছনের ঘটনা জেনেছেন। বর্তমান সময়েও ধর্ষণ লজ্জাজনক হওয়ায় তাদের নাম বদলে দেয়া হয়েছে।
জ্যঁ-পিয়ের (ধর্ষণের শিকার ওই মায়ের ছেলে) জানান, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর সময় একটি ফর্মে তার বাবা-মায়ের নাম জানতে চাওয়া হয়েছিলো। আর ঠিক ওই সময়েই নিজের বাবা সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হয় তার মধ্যে।
তিনি বলেন, আমি তাকে চিনি না। আমি তার নাম জানি না।
ঘরে বাবা না থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। কারণ ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার গণহত্যায় আট লাখ মানুষ নিহত হওয়ায় অনেক শিশুই ছিল পিতৃহীন। কিন্তু তারা তাদের বাবার নাম জানতো। অনেক সময়ই গ্রামে মানুষের মুখে গুঞ্জন শুনেছে সে, এমনকি কয়েকবার নামও শুনেছে। কিন্তু পুরো সত্য জানতে বছরের পর বছর সময় লেগে যায় তার।
ক্যারিনের (ধর্ষণের শিকার ওই মা) ঘটনা শুনলে বোঝা যায়, সত্য বলতে গিয়ে কেন তিনি তার ছেলে বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন। তিনি (ক্যারিন) বলেন, তার (তার ছেলে) কাছে অনেক ধরনের তথ্য ছিল। সে গুজব শুনেছে। গ্রামের সবাই জানে যে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলাম আমি। আর এতে আমার করার মতো তেমন কিছুই ছিল না।
ক্যারিন বলেন, আমার ছেলে জিজ্ঞাসা করতে থাকে যে তার বাবা কে। কিন্তু আমি বলতে পারিনি যে আমাকে ধর্ষণ করা একশ জন পুরুষের মধ্যে তার বাবা আসলে কে।
প্রথম যখন তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তখন তিনি তার ছেলের বয়সীই ছিলেন। তিনি ছিলেন তুতসি নারী এবং শিশুদের মধ্যে যারা হুতু প্রতিবেশী, যোদ্ধা আর সেনাদের হাতে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন বলে মনে করা হয় সেই লাখো নারীদের একজন। তখন গণহত্যা মাত্র শুরু হয়েছিল। তখনো তার মুখের দুপাশে রামদা সদৃশ বস্তুর আঘাতে সৃষ্ট ক্ষত থেকে রক্ত পড়তো। যার কারণে এখনো তার খেতে এবং কথা বলতে সমস্যা হয়। তার উপর আক্রমণকারীরা যারা এতদিন তার সম্প্রদায়েরই মানুষ ছিল, তারা তাকে টেনে হিঁচড়ে একটি গর্তের কাছে নিয়ে যায়, যেখানে আগে থেকেই একটি স্কুলের পুরুষ, নারী আর শিশুদের হত্যার পর মরদেহগুলো জড়ো করছিল তারা। কিন্তু তার ক্ষত আর ব্যথার পরেও ক্যারিন জানতেন যে তিনি মরতে চান না।
সেনাদের হাতে ছোট গাছ ও লাঠির দ্বারা যৌন নির্যাতনের ফলে তার দেহে অভাবনীয় ক্ষতি হবে, একথা জেনেও মরতে চাননি তিনি। তবে এরপর যখন আরেকটি দল তার উপর হামলে পরে তার সারা শরীরে কামড়ের ক্ষত তৈরি করে তখন আর বেঁচে থাকতে চাননি তিনি।
তিনি বলেন, এখন আমি তাড়াতাড়ি মরতে চাই। আমি অনেক বার মরতে চাই।
কিন্তু এটা ছিল তার দুর্ভোগের শুরু মাত্র। যে হাসপাতাল তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল সেটিতেও হামলা চালিয়ে দখলে নেয় হুতু যোদ্ধারা।
তিনি বলেন, আমি পালাতে পারিনি। আমি যেতে পারিনি কারণ আমার সব কিছুই ছিল ভাঙা। যেকেউ চাইলেই আমার উপর যৌন নির্যাতন করতে পারতো।
রুয়ান্ডার প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্টের সেনারা হাসপাতালটি দখল মুক্ত করার পরেই শেষমেশ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেয়েছিলেন ক্যারিন। পরে ফিরেছিলেন তার গ্রামে-দুর্বল, বিধ্বস্ত, রক্তাক্ত কিন্তু জীবিত অবস্থায়। যখন চিকিৎসকরা তাকে খুঁজে বের করেন তখন তিনি গর্ভবতী ছিলেন। যা চিকিৎসকদের জন্য ছিল একটি বড় ধাক্কা।
তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করছিলাম যে আমি আসলে কি করবো। কারণ আমার শরীরে অবশিষ্ট বলতে তেমন কিছুই ছিল না। আমি ভাবতে পারতাম না যে কি হতে যাচ্ছে। যখন শিশুটি জন্ম নিলো, আমি বুঝতে পারি নি কি হল। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে এই শিশুটি আমার থেকেই জন্ম নিয়েছে। আমি সারাক্ষণ ভাবতাম যে আমার সাথে আসলে কি হল। জন্মানোর পর আমি বাচ্চাটিকে রেখে দেই। যদিও তার প্রতি আমার কোন ভালবাসা ছিল না।
শেষমেশ ক্যারিন জ্যঁ-পিয়েরেকে তার ১৯ কিংবা ২০ বছর বয়সে গর্ভধারণ এবং সন্তান জন্মদানের পুরো ঘটনাই বলেন।
পিয়েরে সেটা মেনে নেন। কিন্তু এখনো তার মনে হয় যে, তার জীবনে তার বাবার কমতি রয়েছে। যাইহোক আশ্চর্যজনকভাবে, তার মায়ের উপর যে ব্যক্তি হামলা করেছিলো তাকে ঘৃণা করে না সে। আর, ক্যারিনও তাকে ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
তিনি বলেন, আমার জন্য অন্যতম কষ্টের বিষয় ছিল তাদের সম্পর্কে ভাবা। কিন্তু যখন আমি ক্ষমা করলাম, আমার ভালো লাগতে শুরু করলো।
জ্যঁ পিয়েরে বলেন, তার প্রতি আমার কখনো রাগ হয়নি। মাঝে মাঝে আমি তার সম্পর্কে ভাবি, আমার মনে হয়, জীবনে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমার বাবাকে পাশে পেলে আমার অনেক ভালো লাগতো।
একজন মেকানিক হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নেয়ার চিন্তা করছেন জ্যঁ এবং এক সময় তার নিজেরও একটা পরিবার থাকবে। তিনি বলেন, ‘আমি আমার পরিবারকেও সাহায্য করতে চাই।’। যদিও তার জন্য অর্থের প্রয়োজন আর অর্থই আমার কাছে তেমন নেই।
আর ক্যারিন, বড় হওয়ার পর জ্যঁ পিয়েরের সাথে সম্পর্ক মজবুত করতে কাউন্সেলিংয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, আমি এখন মনে করি এটাই আমার সন্তান।
তাদের নতুন বাড়ির সিঁড়িতে বসে দূর পাহাড়ের দিকে তাদের তাকিয়ে থাকা দেখলে পোক্ত সম্পর্কের আঁচ পাওয়া যায়। গ্রামের পাশেই তাদের বাড়িটি- সেই গ্রাম, যে গ্রামে বেড়ে উঠেছেন ক্যারিন, যে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছেন এক সময়। সেই গ্রাম যেখানে পিয়েরেকে শুধু একজন তরুণ নামে ডাকা হতো। কিন্তু এখন সবকিছু শান্ত। পরিবার আর সম্প্রদায়, সবাই তাদেরকে মেনে নিয়েছে।
‘তারা জানে যে দীর্ঘ সময় ভয়ংকর অভিজ্ঞতার শোকে স্তব্ধ হয়ে পার করেছি আমি এবং এখানে আমি সুখী,’ ক্যারিন বলেন।
আর জ্যঁ পিয়েরে তার মাকে নিয়ে গর্বিত। তিনি বলেন, এটা বোঝাটা একটু কঠিন কিন্তু আমি তার উন্নতিতে খুব খুশী হয়েছি। তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে তিনি যেভাবে নিয়েছেন। ভবিষ্যৎ এবং সামনে এগিয়ে যাওয়া নিয়ে তিনি যেভাবে ভাবেন তা আমার খুবই পছন্দ।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।