
শ্রীনগরের রাস্তায় কিছু কাশ্মীরী যুবক। ছবি : বিবিসি
ভারত শাসিত কাশ্মীরে শুক্রবারের বিক্ষোভের পর থেকেই সেখানে কারফিউ বহাল আছে। গোটা রাজ্য অবরুদ্ধ, কিন্তু তার মধ্যেই বিবিসির কয়েকজন সাংবাদিক যেতে পেরেছেন শ্রীনগরে, তারা দেখতে পেয়েছেন সেখানকার মানুষের মধ্যে কতটা ক্ষোভ-ক্রোধ জমা হয়েছে । বিবিসির গীতা পান্ডে কথা বলতে পেরেছেন শ্রীনগরে বেশ কয়েকজন কাশ্মীরির সাথে।
এক কাশ্মীরী যুবক বলেন, ‘ও আমার একমাত্র ছেলে, যদিও এখনো একেবারেই শিশু কিন্তু ও যেন বড় হয়ে বন্দুক হাতে নিতে পারে তেমনভাবেই ওকে তৈরি করবো’। তিনি বললেন, তিনি নিজেও ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বন্দুক হাতে তুলে নিতে প্রস্তুত।
জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের রাজধানী শ্রীনগরের পথে পথে এখন চলছে ফৌজি টহল ও তল্লাশি, দোকানপাট বন্ধ, জনজীবন স্তব্ধ । আমাদের একেবারে কাছেই পুলিশ দাঁড়ানো। কিন্তু তারা যে এসব কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে – ব্যাপারটা পাত্তাই দিলেন না যুবকটি, এতই ক্ষেপে আছেন তিনি।
ভারতের সংবিধান থেকে কাশ্মীর রাজ্যের স্বায়ত্বশাসন দানকারী ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করার পর থেকে রাজ্যটি কার্যত অবরুদ্ধ এবং বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। টেলিফোন-ইন্টারনেট সংযোগ ছিন্ন, রাজনৈতিক নেতা সহ শত শত লোক গৃহবন্দী বা আটক অবস্থায় আছেন।তবে তার মধ্যেও সেখান থেকে বিক্ষিপ্ত বিক্ষোভ-সহিংসতার খবর আসছে।শ্রীনগরের একটি সরু গলি থেকে বের হয়ে এলেন কয়েকজন লোক। তাদের মধ্যে বয়স্ক একজন বললেন, তারা দিন কাটাছেন সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ অবস্থায়। তাদের ভাষায় সরকার যা করেছে তা হচ্ছে ‘চরম গুন্ডামি।’
আধাসামরিক বাহিনীর জওয়ানরা এসে আমাদের সরিয়ে দেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু এই লোকেরা সরতে রাজী নন। তারা আঙুল তুলে পুলিশের দিকে চিৎকার করতে লাগলেন, ‘তোমরা দিনের বেলা আমাদের আটকে রাখছো, রাতের বেলাও আটকে রাখছো।’ পুলিশ তাদের বলতে লাগলো, ‘কারফিউ জারি আছে, আপনারা এক্ষুণি ঘরের ভেতর ঢুকে যান।’ আমাদেরও বলা হলো এখান থেকে চলে যেতে ।
কারফিউ জারি থাকলেও, শুক্রবার নামাজের জন্য লোকজনকে মসজিদে যাবার সুযোগ করতে দিতে নিরাপত্তা শিথিল করা হয়। এ সময় শ্রীনগরে হাজার হাজার লোক বিক্ষোভে যোগ দেয়। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর ছররা গুলি এবং টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেছে বলে খবর পাওয়া যায়। বুধবার দিল্লি থেকে বিমানে শ্রীনগর এসে নেমেছেন রিজওয়ান মালিক। তার ৪৮ ঘন্টারও কম সময় আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করার কথা ঘোষণা করেছিলেন।
রিজওয়ান মালিক জানান, রবিবার সরকার ইন্টারনেট সহ সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেবার কয়েক ঘন্টা আগে তিনি তার বাবা-মার সাথে শেষ কথা বলেছিলেন। এর পর যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি আর কারো সাথেই কথা বলতে পারছিলেন না। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন, শ্রীনগর ফিরে যাবেন।
রিজওয়ান বলেন, তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদে বিশ্বাসী নন, কখনো সৈন্যদের দিকে একটি ঢিলও ছোঁড়েন নি। তিনি ভারতের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন, জীবনে উন্নতি করাই ছিল তার লক্ষ্য। তার ভাষায়, ‘কারো সাথেই কোনোভাবে যোগাযোগ করার উপায় নেই – আমি জীবনে কখনো এমন অবস্থা দেখিনি’
কিন্ত এখন যা হচ্ছে তা তিনি মানতে পারছেন না। রিজওয়ান বলেন, ‘ভারত যদি আমাদের এটা বিশ্বাস করাতে চায় যে এটা একটা গণতান্ত্রিক দেশ, তাহলে তারা আমাদের বোকা ভাবছে। কাশ্মীরের সাথে বাকি ভারতের সম্পর্ক সব সময়ই অস্বস্তিকরা ছিল, কিন্তু এই বিশেষ মর্যাদাই ছিল এ দুয়ের মধ্যে সেতুর মতো। সেটা বাতিল করে আমাদের আত্মপরিচয় কেড়ে নেয়া হয়েছে, কোন কাশ্মীরির কাছেই এটা গ্রহণযোগ্য নয়।’
রিজওয়ান মালিক বললেন, এই অবরোধ যখন উঠবে, আর বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নামতে পারবে তখন প্রতিটি কাশ্মীরি তাদের সাথে যোগ দেবে, ‘বলা হতো, এখানে সব পরিবারেই এক ভাই যদি বিচ্ছিন্নতাবাদী হয়, তো আরেক ভাই ভারতের মূলধারার পক্ষে। এখন ভারতের সরকার দু ভাইকে এক করে দিয়েছে।’
রিজওয়ানের বোন রুখসার রশিদ, বয়েস ২০। তিনি কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যের ছাত্রী। তিনি বলেন, টিভিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা শোনার পর তার হাত কাঁপছিল, আর তা মা পাশে বসে কাঁদতে শুরু করেছিলেন। রুখসার ভাষায়, ‘আমার মা বলছিলেন এর চেয়ে মৃত্যুও ভালো। আমি এখন ঘুমে মধ্যে আঁতকে উঠি। আমার দাদা-দাদীরা বাটমালু এলাকায় থাকেন। তারা বলছেন, এটা এখন আফগানিস্তান হয়ে গেছে।’
ভারতের সরকার অবশ্য দেখানোর চেষ্টা করছে যে কাশ্মীরে সবকিছুই ঠিক আছে। বুধবার টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখানো হয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ‘জঙ্গীবাদের উর্বর ক্ষেত্র’ বলে কথিত শোপিয়ান শহরে কয়েকজন লোকের সাথে মধ্যাহ্নভোজ সারছেন। কিন্তু কাশ্মীরিরা বলছেন, এটা একটা স্টান্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। রিজওয়ান বলেন, ‘লোকে যদি এতই খুশি হবে তাহলে কারফিউ জারি করতে হলো কেন? সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে হলো কেন?’
পুলওয়ামার বাসিন্দা আইনজীবী জাহিদ হোসেইন দার। তিনি বললেন, ‘কাশ্মীর এখন অবরুদ্ধ। কিন্তু যে মুহূর্তে এটা উঠে যাবে, তকনই শুরু হবে গোলমাল। ভারতের কিছু সংবাদ মাধ্যম বলছে, কাশ্মীরে এখন পর্যন্ত বড় কোন বিক্ষোভ হয় নি; যার অর্থ লোকে সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায়, গত ২০ বছরের মধ্য এবার যে ক্ষোভ-ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ; তা নজিরবিহীন।
এখানকার লোকদের ন্যূনতম চাওয়া হচ্ছে এই – সরকারকে এ আদেশ বাতিল করতে হবে, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে। অবশ্য মোদি সরকারকে সিদ্ধান্ত নিয়ে পিছিয়ে আসার পত্র বলে মনে করা হয় না। কাশ্মীরের লোকেরাও নরেন্দ্র মোদীর ‘নতুন যুগের সূচনার’ কথা শুনে পিছু হটতে তৈরি নয়। শ্রীনগরের একটি হাইস্কুলের ছাত্রী মুসকান লতিফ বলেন, এখনকার অবস্থাটা আসলে ঝড়ের আগেকার শান্ত অবস্থার মতো।